গুরু ভাই বোনসহ সকল সনাতনী ভাই বোনদের জানাই স্বাগত ,উদ্দেশ্য গুরু দেবের অমৃত বানী সকলের মাঝে প্রচার করা।

নশ্বর মানব দেহ ও নাম স্মরণের মাধ্যমে মুক্তি ভূমিকা

 

শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী: নশ্বর দেহ ও নাম স্মরণের মাধ্যমে মুক্তি (১২৭)

নশ্বর মানব দেহ ও নাম স্মরণের মাধ্যমে মুক্তি: রামঠাকুরের বেদবাণী (১২৭)


শ্রী শ্রী রামঠাকুরের এই উপদেশটি মানুষের দেহ ও জীবনের অস্থায়ীত্ব এবং মুক্তি লাভের উপায় নিয়ে রচিত। তিনি এই নশ্বর জগৎকে একটি যাত্রাপথের সাথে তুলনা করেছেন যেখানে কেবল আগমন ও প্রস্থান ঘটে, কিন্তু স্থিতি বা স্থায়িত্ব বলে কিছু নেই। এই চরম সত্যকে উপলব্ধি করে একমাত্র নাম-স্মরণের মাধ্যমেই জন্ম-মৃত্যুর ভয়াবহ চক্র থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব, এটিই বাণীর মূল সুর।

মূল বাণীর মর্মার্থ: দেহ কেন 'মরভূম'?

রামঠাকুরের উপদেশটি মানব জীবনের চারটি মৌলিক সত্যকে তুলে ধরে:

১. দেহের অস্থায়ীত্ব ও মরভূমি

বাণী: "চিরস্থায়ী এই দেহ নহে বলিয়াই ইহাকে মরভূম বলিয়া থাকে।"

ব্যাখ্যা: মানব দেহটি চিরস্থায়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী। এই কারণে দেহকে এবং এই জগৎকে "মরভূম" (মরণশীলদের ভূমি বা যেখানে মৃত্যু অনিবার্য) বলা হয়েছে। এখানে জীবন ক্ষণিকের, স্থায়িত্বহীন।

২. স্থিতিহীন আগমন ও প্রস্থান

বাণী: "কেবল আগমপায়ী [আগমন-প্রয়াণকারী] আসে আর যায়, **স্থিতি নাই**।"

ব্যাখ্যা: এই পৃথিবীতে সবাই আগন্তুক। কেবল মানুষ আসে (জন্ম নেয়) এবং যায় (মৃত্যুবরণ করে)। এই আসা-যাওয়ার মধ্যে কোনো স্থায়িত্ব বা চিরন্তন অবস্থান নেই। জীবন একটি চলন্ত প্রবাহ মাত্র।

৩. নাম-স্মরণ: মুক্তি লাভের সহজতম পথ

বাণী: "এইজন্য জন্ম-মৃত্যুর জন্য দুঃখ না করিয়া **নাম করিতে করিতে দেহত্যাগ হইলেই** আর এই মরভৌতিক জগতে জনমে মরণের অধীন হয় না, **মুক্তিপদ লাভ করিতে পারে**।"

ব্যাখ্যা: যেহেতু দেহের বিনাশ নিশ্চিত, তাই জন্ম বা মৃত্যুর জন্য শোক বা দুঃখ করা অর্থহীন। বরং, যখন দেহত্যাগের সময় আসে, তখন সেই মুহূর্ত পর্যন্ত **ভগবানের নাম** জপ করতে থাকা উচিত। নাম জপ করতে করতে দেহত্যাগ করলে মানুষ জন্ম-মৃত্যুর অধীন এই নশ্বর জগতে আর ফিরে আসে না—সে **মুক্তিপদ বা মোক্ষ লাভ** করে।

৪. অনিবার্য দেহত্যাগ

বাণী: "যখন যাহার সময় হয় তখনই তাহাকে এই **দেহজরাপিণ্ড ত্যাগ করিতে হয়**।"

ব্যাখ্যা: দেহের বিনাশ অনিবার্য এবং তা সময় মতোই ঘটবে। "দেহজরাপিণ্ড" (জরাগ্রস্ত বা ধ্বংসশীল দেহের সমষ্টি) ত্যাগ করার সময় কারোরই নিজের হাতে নেই, এটি নির্দিষ্ট সময়েই সম্পন্ন হয়।


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রেক্ষাপটে বিশেষ ব্যাখ্যা

১. দেহের নশ্বরতা এবং আত্মার নিত্যতা

রামঠাকুর দেহকে "চিরস্থায়ী নহে" বলার মাধ্যমে গীতার **জ্ঞানযোগের** প্রথম শিক্ষাকেই তুলে ধরেন। গীতার **দ্বিতীয় অধ্যায় (২/২২)-এ** শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

वासांसि जीर्णानि यथा विहाय नवानि गृह्णाति नरोऽपराणि।

तथा शरीराणि विहाय जीर्णान्यन्यानि संयाति नवानि देही॥

অর্থ: মানুষ যেমন পুরোনো বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, তেমনই **দেহী (আত্মা)** জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নতুন শরীর গ্রহণ করে।

রামঠাকুর এই দেহকে "মরভূম" বলেছেন, আর গীতা দেহের **অনিত্যতা** প্রতিষ্ঠা করে **আত্মাকে অবিনশ্বর** ঘোষণা করে—তাই জন্ম-মৃত্যুর জন্য শোক করা উচিত নয়।

২. ভক্তিযোগ ও মোক্ষ লাভ

নাম-স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করে মুক্তি লাভের কথাটি গীতার **ভক্তিযোগের** ধারণার সাথে সম্পর্কিত। এই মুক্তিই হলো সেই পরম স্থিতি যার কথা গীতার **ষষ্ঠ অধ্যায়ের (৬/২২) শ্লোকে** বলা হয়েছে:

यं लब्ध्वा चापरं लाभं मন্যते नाधिकं ततः।

यस्मिन् স্থিতो न दुःखेन गुरुणাপি विचाल्यते॥

বঙ্গানুবাদ: যাকে লাভ করার পর (যোগী) আর অন্য কোনো লাভকেই তার চেয়ে বেশি বলে মনে করেন না, এবং যাতে (সেই অবস্থায়) সুপ্রতিষ্ঠিত থাকলে তিনি মহাদুঃখ দ্বারাও বিচলিত হন না, (সেই অবস্থাই হলো যোগ)।

রামঠাকুরের "মুক্তিপদ লাভ" গীতায় বর্ণিত **মোক্ষ** বা **ব্রহ্মনির্বাণের** সমার্থক। **নাম-স্মরণ** হলো ভক্তিযোগের এক প্রধান অঙ্গ, যা মোক্ষের পথ প্রশস্ত করে।


সমাপ্তি

শ্রী শ্রী রামঠাকুরের এই বাণীটি **জীবনের চরম লক্ষ্য** হিসেবে মুক্তিকে নির্দেশ করে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের **সহজতম পথ** হিসাবে **নাম-স্মরণ বা নাম জপকে** প্রতিষ্ঠা করে। দেহের নশ্বরতাকে মেনে নিয়ে কেবল নামকেই অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করাই এই বাণীর মূল শিক্ষণীয় বিষয়।


উৎস: শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী, তৃতীয় খণ্ড, উপদেশ সংখ্যা ১২৭।

নশ্বর মানব দেহ ও নাম স্মরণের মাধ্যমে মুক্তি ভূমিকা নশ্বর মানব দেহ ও নাম স্মরণের মাধ্যমে মুক্তি ভূমিকা Reviewed by শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণ নমঃ(SriSriramthakur O gan Ganer vhovon Youtube channel) on September 29, 2025 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.