সাবিত্রী ব্রত ও অবিচ্ছেদ যোগ — বেদবাণী ২য় খণ্ড/৭১
মনের চঞ্চলতা থেকে সত্যের আশ্রয়ে—সাবিত্রী ব্রত, ব্রজবাসী ভাব ও অবিচ্ছেদ যোগের সারবস্তু, সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা ও বাস্তব প্রয়োগ।
সূচিপত্র
বেদবাণী ২য় খণ্ড/৭১ — মূল পাঠ
“মনের স্বভাব প্রকৃতির গুণাবর্ত্তনে পরিয়া চঞ্চল হইয়াই জীবরূপ উপাধি হয়।
মনের সঙ্গে না থাকিতে চেষ্টা করিয়া সত্যবানের অধীনে থাকিতে চেষ্টা করিবেন।
ইহাই সাবিত্রী ব্রত বলিয়া জানিবেন।
কালের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া ব্রজবাসী হইয়া অবিচ্ছেদ যোগ লাভ হয়।
এখানে মন থাকে না, মঞ্জরী হয়।
বুদ্ধি থাকে না, চিন্ময় হয়।
প্রাণ থাকে না, আনন্দময় হয়।
কেবল মাত্র ধর্ম্মই থাকে।
এই ভাবকেই যোগ বলে, বিয়োগ থাকে না।”
— বেদবাণী, ২য় খণ্ড/৭১ | জয়রাম, জয়গোবিন্দ
মূল ভাবনা: এক নজরে
- মন ≠ আমি: মন প্রকৃতির ত্রিগুণে চঞ্চল; এটিই ‘জীব’ উপাধি দেয়।
- সাবিত্রী ব্রত: মনের দাসত্ব ত্যাগ করে সত্যবানের অধীনে থাকা—সত্য-অভ্যাস।
- কালের অতীত অবস্থান: সত্যে স্থিত হলে ‘সময়ের দাসত্ব’ কেটে যায়।
- ব্রজবাসী ভাব: হৃদয়ে ভগবৎস্মরণ এমন স্বাভাবিক যে বিচ্ছেদ বোধ থাকে না।
- রূপান্তর: মন→মঞ্জরী, বুদ্ধি→চিন্ময়, প্রাণ→আনন্দময়; কেবল ধর্ম স্থিত।
- অবিচ্ছেদ যোগ: যোগ মানে বিয়োগ নয়—চির সংযোগের অনুধ্যান।
গভীর ব্যাখ্যা
১) ‘মন’ কেন চঞ্চল?
প্রকৃতির সত্ত্ব-রজ-তম—এই তিন গুণের টানাপোড়েনে মন সদা পরিবর্তনশীল। ফলে আমাদের পরিচয় ‘শুদ্ধ আত্মা’ থেকে সরে গিয়ে ‘জীব’ উপাধিতে সীমাবদ্ধ হয়। এই সীমাবদ্ধতাই দুঃখের মূল।
২) সত্যবানের অধীনে থাকা মানে কী?
‘সত্যবান’ এখানে নিত্য-সত্য, ঈশ্বর-তত্ত্বের প্রতিশব্দ। চিন্তা- কথা- কাজে সত্য-অনুশীলন—অর্থাৎ সত্যানুশীলন—করাই ব্রত। এতে মন নিয়ন্ত্রিত হয়, অন্তঃশুচিতা জন্মায়।
৩) সাবিত্রী ব্রত — শাস্ত্রীয় প্রতিধ্বনি
সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনিতে যেমন ‘সত্যে স্থিত স্ত্রীশক্তি’ মৃত্যুকেও জয় করে, তেমনি সাধকের ‘সত্যব্রত’ কালের গ্রাস থেকে চিত্তকে উদ্ধার করে।
৪) ব্রজবাসী ভাব ও অবিচ্ছেদ যোগ
ব্রজবাসী ভাব মানে—ভক্তির স্বাভাবিকতা। যেখানে স্মরণ, কীর্তন, সেবায় ভগবান অন্তরের নিত্য-সহচর। এই অবস্থাই অবিচ্ছেদ যোগ—যোগের চূড়ান্ত প্রাপ্তি, যেখানে বিচ্ছেদ বোধই বিলীন।
৫) রূপান্তরের গতি
- মন → মঞ্জরী: মন যখন ভক্তির কুঁড়ি হয়ে ওঠে, চঞ্চলতা প্রস্ফুটনে রূপ নেয়।
- বুদ্ধি → চিন্ময়: তর্ক নয়, জ্ঞান স্বতঃপ্রভ আলোক হয়ে জ্বলে।
- প্রাণ → আনন্দময়: প্রেরণা হয় অনন্দ-স্বরূপ; ক্লান্তি ক্ষয় হয়।
- কেবল ধর্ম: নৈতিক-আধ্যাত্মিক ধর্ম—স্বধর্মে প্রতিষ্ঠা।
বাস্তব অনুশীলন: ধাপে ধাপে
- প্রভাতে ৫ মিনিট ‘সত্য-স্মরণ’: শ্বাস-প্রশ্বাসে মৃদু জপ—“গুরুকৃপাহি কেবলম্” (১-২ মালা)।
- দৈনিক সত্য-অডিট: একটি ডায়েরিতে লিখুন—আজ কোন ভাবনা/কথা/কাজে সত্যে স্থিত রইলাম?
- নিয়মিত শ্রবণ-কীর্তন: প্রতিদিন ১৫ মিনিট শাস্ত্র/বেদবাণী পাঠ ও নাম-কীর্তন।
- সেবা-সঙ্কল্প: সপ্তাহে একবার নির্লোভ সেবা—কারও উপকারে নীরবে থাকা।
- রাত্রিকালীন পর্যালোচনা: ‘মন-মঞ্জরী’ প্রস্ফুটনের ৩টি লক্ষণ লিখুন—শান্তি, সহানুভূতি, স্থিরতা।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
সাবিত্রী ব্রত কি নির্দিষ্ট উপবাস বা রীতিতে বাঁধা?
মূলত এটি সত্য-আচরণের ব্রত। যে কোনও ভক্ত নিজ সামর্থ্য ও গুরুবচন অনুযায়ী নিয়ম নিলে তা ফলপ্রদ হয়।
‘কালের হাত’ থেকে মুক্তি—এটা কি বাস্তবে সম্ভব?
শরীর সময়ের নিয়মে আবদ্ধ; কিন্তু চিত্ত যখন সত্যে স্থিত হয়, তখন দুঃখ-সুখে সমত্ব জন্মায়—সময়ের গ্রাস কম অনুভূত হয়। এটিই শাস্ত্রের ‘কালাতীত বোধ’।
অবিচ্ছেদ যোগে পৌঁছাতে কত সময় লাগে?
সময়ের হিসাব নয়—অভ্যাসের ধারাবাহিকতাই মুখ্য। গুরু-শরণাগতি ও সৎ-সঙ্গ গতি বাড়ায়।
সমাপ্তি: প্রার্থনা ও সংকল্প
“জয়রাম, জয়গোবিন্দ।” হৃদয়ে এই নাম রেখে আজ থেকে আমরা সত্যব্রতে অটল থাকার সংকল্প নিই—মনকে মঞ্জরী, বুদ্ধিকে চিন্ময়, প্রাণকে আনন্দময় করার পথে গুরুকৃপা লাভ করি।
— গুরু কৃপাহি কেবলম্

No comments: