ভগবানের শরণে শান্তি: শ্রীশ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী (১ম খণ্ড — ৯৮) বিশ্লেষণ
উদ্ধৃতি (মূল বক্তব্য)
ভগবানের শরণ নিয়া থাকিলেই পরিণামে শান্তির উপর স্থান প্রাপ্ত হয়। ইহ জগতে দেহের সঙ্গেই ভাগ্য অনুসারে ফলাফল ভোগ হইয়া থাকে।পরশ্রীতে কাতরতা কেবল মূর্খের সম্পদ বলিয়া জানিতে হয়।ভাগ্য অনুসারে শারীরিক,মানসিক সুখ দুঃখাদি আবর্তন হইয়া জীবভাবে মণ্ডিত থাকে,জ্ঞান অজ্ঞানের বশবর্তী হয়।সংসার মায়াময়,ভগবৎ শরণে কেবল দেহ নাশেই দৈহিক,মানসিক সন্তাপাদি ভোগের দ্বারা মুক্ত হইয়া থাকে।দেহে গুণের হ্রাস বৃদ্ধি অনুসারে সহ অসহ যাতনা সুখ,দুঃখ,পাপ,পূণ্য,ধর্ম,অধর্মাদি ইত্যাকার জ্ঞান জন্মে। ইহাকেই প্রারব্ধ বলে,এই প্রারব্ধ ভোগ ভিন্ন শেষ হয় না বলিয়া ঈশ্বরের শরণ নিয়া পড়িয়া থাকিতে হয়।পাপ পূণ্য ধর্মাধর্মে লক্ষ্য রাখিতে নাই।প্রাক্তনে যাহা হয় আছে তাহা ভোগ করিবে,দেহান্তে ভগবৎ পদ গুরু বাক্য যাহা নির্দেশ করিয়াছে তাহা পাইবে,সন্দেহ নাই।মনের শান্তির অশান্তির ধার না নিয়া অকর্তা হবার চেষ্টা করিবে।
-শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
(বেদবাণী ১ম খণ্ড — ৯৮)
সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ
এই বেদবাণীতে শ্রীশ্রী রামঠাকুর বলছেন— ভগবানের (গুরু/ভগবৎ) আশ্রয় গ্রহণ করলে চূড়ান্ত শান্তি পাওয়া যায়। জগতের দেহগত জীবন ও ভাগ্যের ফল (প্রারব্ধ) অনুসারে আমরা সুখ-দুঃখ ভোগ করি; তাই অতিমাত্রায় দেহগত বা পরকার প্রতি কাতরতা মূর্খতাময়। শেষপর্যন্ত মুক্তির পথ ভগবৎ শরণেই, যেখানে দেহগত কষ্ট ও মানসিক কাঁটা ধীরে ধীরে নির্মূল হয় এবং গুরু-বক্তব্য অনুসারে জীব আত্মার গন্তব্য পায়।
বাক্যভিত্তিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ
১) "ভগবানের শরণ নিয়া থাকিলেই পরিণামে শান্তির উপর স্থান প্রাপ্ত হয়।"
গুরু বা ভগবৎ-শরণ মানে কেবল বাহ্যিক ভক্তি নয় — এটি মানসিক সমর্পণ, আত্মপরোর্থতা এবং জীবনের মূল্যবোধে গতি আনা। রামঠাকুর বলেছেন, এটাই চূড়ান্ত শান্তির পথ। ধারাবাহিক অনুশাসন ও বিশ্বাসে মন হঠাৎ করে স্থির হয় এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি অর্জিত হয়।
২) "ইহ জগতে দেহের সঙ্গেই ভাগ্য অনুসারে ফলাফল ভোগ হইয়া থাকে... ভাগ্য অনুসারে শারীরিক, মানসিক সুখ দুঃখাদি আবর্তন হইয়া জীবভাবে মণ্ডিত থাকে"
এখানে 'প্রারব্ধ' বা ভাগ্য-ধারণার ধারণা উঠে আসে — শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতি আমাদের জন্মগত বা গতিকৃত কারণে আবর্তিত হয়। অর্থাৎ জীবনজটিলতায় সুখ-দুঃখ লাগাতার চলে; এর সময়োপযোগী স্বীকারোক্তিই রামঠাকুরের দর্শন।
৩) "পরশ্রীতে কাতরতা কেবল মূর্খের সম্পদ"
রামঠাকুর সতর্ক করেন— অন্যের সুখ-দুঃখে অতিশয় কাতর হওয়া (অর্থাৎ পরশ্রী-অধিকারে অতিমাত্রায় আবেগী হওয়া) বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বাস্তবে আত্মশক্তি ও ভগবৎ শরণে অধিক গুরুত্ব থাকে।
৪) "সংসার মায়াময়, ভগবৎ শরণে কেবল দেহ নাশেই ... মুক্ত হইয়া থাকে"
সংসারকে রামঠাকুর মায়াময় বলে চিহ্নিত করেছেন— সংযুক্তি থেকে মুক্তি ভগবৎ শরণে সম্ভব। 'দেহ নাশ' এখানে শাব্দিকভাবে নয় বরং দেহগত বেঁধে থাকা আবেগ-অহংকারের ধ্বংস বা অনাসক্তি-অবস্থা বোঝায়।
৫) "পাপ পূণ্য ধর্মাধর্মে লক্ষ্য রাখিতে নাই... প্রারব্ধ ভোগ ভিন্ন শেষ হয় না বলিয়া ঈশ্বরের শরণ নিয়া পড়িয়া থাকিতে হয়"
রামঠাকুর বলছেন— অতিমাত্রায় পাপ-পুণ্যের হিসেব কষতে গিয়ে ভক্তি-ভাগ্যকে ভূলভাবে বুঝে ফেলা যায়। বরং ভাগ্যভোগ এবং জীবের ফলাপেক্ষায় ভগবানের দিকেই সমর্পণই নিরাপদ পথ। শেষ পর্যায়ে গুরু-বক্তব্য মেনে চলাই মুক্তির নিমিত্ত।
৬) "মনের শান্তির অশান্তির ধার না নিয়া অকর্তা হবার চেষ্টা করিবে"
এখানে একটি অনুশাসন রয়েছে— সুচিন্তিতভাবে 'অকর্তা' বা নিরিকারতা (detachment) অর্জন করা; মানসিক ওঠাপড়া নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবেন না, বরং কার্য সম্পাদন করে গুরুবাণীর উপর ভর করুন।
আচরণগত টিপস (Practical takeaways)
- দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন কিছু সময় গুরুবাণী স্মরণে বা ধ্যানে কাটান—রামঠাকুরের উপদেশে ধারাবাহিকতা শান্তি আনে।
- অতিরিক্ত পরশ্রী-কাতরতা থেকে নিজের আত্মশক্তি ক্ষীণ করবেন না; সহানুভূতিশীল কিন্তু স্থিতপ্রতিভ থাকুন।
- প্রারব্ধ/ভাগ্যকে কাজে লাগিয়ে নিজের কর্তব্য পালন করুন—ফলাফল ভগবতের উপর ছেড়ে দিন।
- আত্মবিশ্লেষণ ও অনাসক্তির অনুশীলন করুন—এতে দেহগত আবেগ ধীরে ধীরে হালকা হবে।
উপসংহার
শ্রীশ্রী রামঠাকুরের এই বেদবাণী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়— জীবনের পরিবর্তনশীলতা, ভাগ্য-ফল এবং সংসারের মায়া থাকা সত্ত্বেও, ভগবানের শরণে মনের চূড়ান্ত শান্তি সম্ভব। গুরু-বক্তব্য মেনে চলা ও অনাসক্তির চর্চা হল মুক্তির কার্যকর পথ।

No comments: