জগত্-পিতা (Jagat Pita) ও জগত্-গুরু (Jagat Guru) — শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা
শাস্ত্রে কিভাবে ভগবানকে 'জগত্-পিতা' ও 'জগত্-গুরু' বলা হয়েছে — গীতার উদ্ধৃতি, উপনিষদিক সংকেত এবং সহজ ব্যাখ্যা।
১. জগত্-পিতা (Jagat Pita)
অর্থ: 'জগৎ' মানে সৃষ্ট জগৎ, 'পিতা' মানে পিতা/উৎপত্তিদাতা। তাই 'জগত্-পিতা' বলতে বোঝায় সেই পরম শক্তিকে, যিনি সমস্ত জীবের স্রষ্টা, বীজপ্রদানকারী ও পালনকর্তা।
শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতিসমূহ
श्रीभगवानुवाच —
"अहं बījaḥ ... पिता" (BG 9.17) —
"অহং - বিঝঃ প্রদঃ পিতা মাতা ধাতা পিতামহঃ।"
গীতার এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্টভাবে বলেন যে তিনি সার্বজনীন পিতা-মাতা-ধাতা — অর্থাৎ সমস্ত জীবের উৎপত্তি ও সংরক্ষণকারীরূপে তিনি পরিচিত।
"सर्वयोनिषु कौन्तेय मूर्तयः सम्भवन्त्यतः। तासां ब्रह्म महद्योनि: अहं बीजप्रदः पिता।।" (BG 14.4)
এখানে বলা হয়েছে প্রকৃতি নানা রূপে জীবের জন্ম দেয়; কিন্তু আমি (ঈশ্বর) সেই জন্মের বীজদাতা পিতা। তাই শাস্ত্রে 'জগৎ-পিতা' ধারণাটি ঈশ্বরের দর্শনের অন্যতম অংশ।
ব্যাখ্যা
জীব এবং প্রকৃতির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে গীতা বলেছে যে জীবঋৎ সূচনা পায় প্রকৃতির বিশিষ্ট ক্রিয়াবলীর মাধ্যমে, কিন্তু এর মূল — বীজ, এবং সেই বীজদানকারী হলেন ঈশ্বর। অতএব ঈশ্বরই জগৎ-পিতা।
২. জগত্-গুরু (Jagat Guru)
অর্থ: 'জগত্-গুরু' হলো সেই আধ্যাত্মিক শিক্ষক বা আদর্শ গাইড যিনি শুধুমাত্র একক সম্প্রদায় বা ব্যক্তির নয়, বরং সমগ্র জগতের জন্য পথপ্রদর্শক।
শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি
"इमं विवस्वते योगं प्रोक्तवानहमव्ययम्। विवस्वान्मनवे प्राह मनुरिक्ष्वाकवेऽब्रवीत्॥" (BG 4.1)
শ্রীকৃষ্ণ এখানে বলছেন—তিনি শুরু করেছিলেন যোগশিক্ষা এবং তা বিবস্বান (সূর্য) প্রভৃতি মাধ্যমে প্রজন্মান্তরে মানুষ ও রাজাবোদ্ধদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এভাবেই বিদ্যার ধারাবাহিকতা ও 'গুরু-parampara' গড়ে ওঠে, যেখানে ঈশ্বরই মূল আদৰ্শ-গুরু।
"आचार्यं मां विजानीयान् ... सर्वदेवमयो गुरुः" (SB 11.17.27 — অনুবাদসূত্র)
পুরাণে বলা হয় আচার্যকে ভগবানের সঙ্গে সমতুল্য বিবেচনা করা উচিত—কারণ আচার্যের মধ্যে ভক্ত ও শাস্ত্রীয় জ্ঞানের প্রতিভা উপস্থিত থাকে; তিনি 'জগত্-গুরু' হিসেবে কার্যকর হন।
ব্যাখ্যা
জগত্-গুরু শুধুমাত্র তত্ত্ব বা বিদ্যা প্রদর্শন করেন না; তিনি জীবনে ধর্ম-দীক্ষা, আচার-অনুশাসন ও ভক্তি-পথের বাস্তব নির্দেশনা দেন। অনেক শাস্ত্রে 'আচার্য' বা 'গুরু'কে ভগবানের দৃষ্টিতে দেখার উপদেশ আছে—এটি গুরুর মহত্ত্বকে জাগ্রত করে।
৩. জগৎ-পিতা এবং জগৎ-গুরু — পার্থক্য ও সম্পর্ক
- জগৎ-পিতা — অধিকতর সৃষ্টিকর্তা-সত্তার নির্ধারক; জীব, প্রকৃতি ও বিশ্ব-চক্রের মূল উৎস।
- জগৎ-গুরু — আধ্যাত্মিক শিক্ষক বা পথপ্রদর্শক; ধর্ম, শিক্ষা ও উপাসনার নিয়ম প্রচারকারী।
- শাস্ত্রে কখনও কখনও ঈশ্বরই উভয় ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত—জীবের উৎপত্তি ও পথ-প্রদর্শক উভয়ই।
সংক্ষেপে — জগৎ-পিতা হলেন সর্বব্যাপী স্রষ্টা/পিতা, আর জগৎ-গুরু হলেন সেই আচার্য/গুরু যারা ঈশ্বরের প্রদত্ত শিক্ষাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে ও ছড়িয়ে দেন।
৪. উপসংহার
শাস্ত্রে 'জগৎ-পিতা' ও 'জগৎ-গুরু'—দুইটি ধারণাই ঈশ্বরের বিভিন্ন দিককে বোঝায়: একটি স্রষ্টা-ঐশ্বরিকতা; অন্যটি শিক্ষা-নির্দেশকতা। গীতার উদ্ধৃতি ও পুরাণীয় উল্লেখ দেখায় যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই এই ভূমিকাগুলো ধারণ করেন — তাতে ভক্তরাও ঈশ্বরকে পিতা ও গুরু হিসেবে সম্মান করা শিখেন।
II KRISHNA KRISHNA KRISHNA KRISHNA II

No comments: