গুরুর শক্তি ও বিনয়: অহংকার ত্যাগে শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বাণী
আধ্যাত্মিক জীবনের মূলসূত্র: শ্রী শ্রী রামঠাকুরের উপদেশ
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের "গুরুর শক্তি ও বিনয়" শীর্ষক বাণীটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্ম, সম্পর্ক, এবং আত্ম-পরিচিতির উপর এক গভীর আলোকপাত করে। তাঁর এই উপদেশটি মূলত বেদবাণী ৩/(১৫২) থেকে নেওয়া হয়েছে, যা আমাদের শেখায় কীভাবে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হতে হয়।
১. ভগবানের দিকে লক্ষ্য রেখে কর্ম সম্পাদন
বাণী: "কেবল দিবানিশি ভগবানের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া সংসারের উপস্থিত মতে কার্য্য করিয়া যাইতে চেষ্টা করুন।"
গুরুত্ব: আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজ—তা ছোট হোক বা বড়—তাঁকে বা তাঁর উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত। এখানে 'দিবানিশি' শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, মনকে এক মুহূর্তের জন্যও গুরু বা ভগবান থেকে বিচ্যুত করা চলবে না।
শিক্ষা: সংসারের দায়িত্ব পালন করতে হবে, কিন্তু সেই কর্মের ফল বা উদ্দেশ্য যেন সর্বদাই ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত হয়। এটি আমাদের কর্মকে পূণ্যকর্মে পরিণত করে।
২. পারিবারিক সম্পর্ক এবং গুরুর ইচ্ছা
বাণী: "পরিবারকে ঘৃণা করিতে নাই। সকলি গুরুর শক্তি। গুরুর ইচ্ছায়ই সকল সংযোগ হইতেছে।"
গুরুত্ব: পরিবারের প্রতি স্নেহ বা ঘৃণা—কোনোটাই যেন আমাদের মনকে গ্রাস না করে। গুরু ঠাকুর স্পষ্টভাবে বলছেন যে আমাদের জীবনের সকল সম্পর্ক (পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন) গুরুর শক্তির মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
শিক্ষা: জীবন এবং সম্পর্কের প্রতিটি সংযোগই হলো গুরুর আশীর্বাদ ও ইচ্ছা। তাই অহংকার বা রাগ নয়, বরং কৃতজ্ঞতা ও সমর্পণ-এর মনোভাব রাখা উচিত।
অহংকার ও মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি
৩. অহংকার: কর্মবন্ধনের মূল কারণ
বাণী: "অহংকারের দ্বারা অভিমানী হইয়া আমার স্ত্রী, আমার পুত্র, আমার ধন, আমার শরীর জ্ঞান করিয়া জীব কর্ম্মপাশে বদ্ধ হয়।"
গুরুত্ব: 'আমার' বা 'আমি'-ভাবনাটাই হলো কর্মবন্ধনের প্রধান কারণ। যখন আমরা শরীর, অর্থ, বা সম্পর্ককে নিজেদের বলে মনে করি, তখন আমরা মায়ার জালে জড়িয়ে পড়ি।
শিক্ষা: এই 'আমার' জ্ঞান থেকে মুক্তি পেলেই জীব সত্যিকারের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারে এবং জীবনের মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়।
৪. শ্লোকের গভীর তাৎপর্য: 'সকলি গুরুর'
বাণী: "স্বদেহমিন্দ্রিয় ভার্য্যা অর্থ স্বজন বান্ধবাঃ। পিতা মাতা কুলং দেবি গুরুরেব ন সংশয়ঃ॥"
বিশ্লেষণ: এই শ্লোকটি আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মন, ইন্দ্রিয়, স্ত্রী, পুত্র, অর্থ, এবং এমনকি পিতা-মাতা—এই সমস্ত সম্পর্ক-কেই গুরুর শক্তি এবং ইচ্ছার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে।
সিদ্ধান্ত: এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, 'ন সংশয়ঃ' (কোনো সন্দেহ নেই) যে আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি দিকই গুরুময়। এই উপলব্ধি আমাদের মিথ্যা অহংকার থেকে দূরে রাখে।
৫. মিথ্যা জ্ঞান ও সত্য জ্ঞান
বাণী: "এই শ্লোকটিতেই বুঝিতে পারেন যে আমার জ্ঞানই মিথ্যা, ভগবৎ জ্ঞানই সত্য। সকলি গুরুর, যদি আমারই আমি না হই তবে আমার কি হইবে ? সকলি ভ্রান্তি।”
গুরুত্ব: শ্রী শ্রী রামঠাকুর চূড়ান্ত সত্যটি প্রকাশ করছেন: আমাদের আত্মপরিচয় বা 'আমার জ্ঞান' সম্পূর্ণ মিথ্যা। একমাত্র ভগবৎ জ্ঞান বা গুরুর জ্ঞানই সত্য।
উপসংহার: যদি আমরা নিজেদেরকে গুরুর থেকে আলাদা মনে করি, তবে আমাদের সমস্ত কিছু 'ভ্রান্তি' বা ভ্রম হিসেবে প্রতিভাত হবে। গুরুর শরণাগত হওয়াতেই নিহিত রয়েছে জীবনের প্রকৃত শান্তি ও আত্মসিদ্ধি।
চূড়ান্ত শিক্ষা: গুরুর প্রতি সমর্পণ
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের এই বাণীটি আধ্যাত্মিক সাধকদের জন্য একটি মহাসূত্র। এটি আমাদের শেখায় যে, জাগতিক জীবনে থেকেও কীভাবে অহংকার ত্যাগ করে, বিনয় ও সমর্পণের মাধ্যমে জীবনকে সত্য ও
শান্তি পূর্ণ করা যায়। পরিবার, ধন-সম্পদ, এমনকি আমাদের শরীরও গুরুর দান—এই সত্য উপলব্ধি করে সর্বদা গুরুর নির্দেশ মেনে চলাই আমাদের একমাত্র কাজ।

No comments: